ঢাকায় তাকে ধরাই যাচ্ছিল না। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কাজ, সভা-সমাবেশে বক্তৃতা, লেখালেখির কাজে দারুণ ব্যসত্ম সময় কাটাচ্ছেন। আনন্দ আলোর জন্মদিন সংখ্যায় তাঁর একটা সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে চাই- একথা বলতেই একটু ভেবে নিয়ে জানালেন, ঢাকায় হবে না।  আমি সোনারগাঁওয়ের পাশে পাকুন্দায় থাকব। সেখানে আসতে পার। নির্ধারিত দিনে ঢাকা থেকে পাকুন্দার উদ্দেশে যাত্রা শুরু হলো আমাদের। প্রিয় শিক্ষকের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। ঢাকা থেকে গাড়িতে মাত্র দেড়ঘণ্টার পথ। দূর থেকে নজরে এল একটি সাদা বিল্ডিং। দিক নির্দেশনা বলছে এই বাড়িতেই আছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। লেখালেখির কাজে তিনি ঢাকার কোলাহল ছেড়ে প্রিয় ছাত্র আলোকচিত্রী এম এ তাহেরের এই বাড়িতে উঠেছেন। প্রায়শই তিনি এখানে আসেন। আমরা সহজেই পৌঁছে গেলাম। স্যার ঘুমাচ্ছেন। উঠলেন ৫টার দিকে। বাড়ির তৃতীয়তলায় আমরা বসলাম সাক্ষাৎকার নিব বলে। ভাবছি কোত্থেকে শুরু করব? কোন পরিচয়ে বড় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ? ষাট দশকের সাহিত্য আন্দোলনের নেতা, খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ, অদম্য সংগঠক, অপরাজেয় টিভি উপস্থাপক, অপ্রতিদ্বন্দ্বী বক্তা, পরিবেশ ও সমাজের শুশ্রূষাকারী, নাকি আলোকিত মানুষের স্বপ্নদ্রষ্টা? তাকে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য এতসব বিশেষণের এখন আর প্রয়োজন নাই। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এই নামটিই যথেষ্ট। তাই অতি সাধারণ একটি প্রশ্ন দিয়ে শুরু হলো আমাদের সাক্ষাৎকার যাত্রা…

আনন্দ আলো: শহর থেকে অনেক দূরে গ্রামে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে একটা পত্রিকা। কেন? কী মনে হচ্ছে আপনার?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: হয়তো কিছুটা আমার টানে, কিছুটা গ্রামের টানে… কারণ ঢাকায় ব্যসত্মতার কারণে আমাদের মাঝে যোগাযোগ খুব কমই হয়। আবার এ কথাও সত্য ঢাকায় সবার সঙ্গে সবার দেখা হলেও নিজের সঙ্গে দেখা হয় খুব কম। শহরের মধ্যে আমরা নানা রকম কাজ, দায়িত্ব, দুর্ভাবনা, দুশ্চিনত্মার বৃশ্চিক দংশনের মধ্যে সময় কাটাই। গ্রামে এলে হঠাৎ এর থেকে বিচ্ছিন্ন হই। এই পরিবেশ মনটাকে রিল্যাক্স করে দেয়। অবকাশের আনন্দে মন ভরে যায়। হাত-পা ছড়িয়ে বসতে পারি, ভালো লাগে। পত্রিকাটি হয়তো এই আনন্দ খুঁজতেও গ্রামে আমার কাছে ছুটে এসেছে- হা… হা… হা…

আনন্দ আলো: আমরা একজন তারকার খোঁজে এসেছি। আপনার কাছে তারকা কারা?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: তারকা শব্দটা নিয়ে আমি আগেও বহুবার ভেবেছি বলেছিও। শব্দটার মধ্যে একটা বিচ্ছিন্নতা আছে। ফিল্মে স্টার হয়। তারা দূরে দূরে থাকে। তারা রহস্যে ঘেরা। ধরাছোঁয়ার বাইরে। কাছে যাওয়া যাবে না। ছোঁয়া যাবে না। এরকম একটা ব্যাপার তাদের মধ্যে থাকে। কিন্তু অন্যক্ষেত্রে যারা স্টার তাদেরকে রাসত্মায় রাসত্মায় ঘুরতে হয়। পলিটিক্যাল স্টারকে অনেক ঘাম ঝরিয়ে মানুষের কাছে আসতে হয়। বাসত্মবতা ও সুখ দুঃখের সঙ্গী হতে হয়। ধরা যাক, একজন লেখক যদি জনবিচ্ছিন্ন থাকেন তাহলে তিনি কখনোই ভালো লেখক হবেন না। মানুষের কটু সাহচর্য, সুখ-দুঃখপূর্ণ সান্নিধ্য তাকে পেতে হবে। এবং জগতের সমসত্ম দুঃখ কষ্টের মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হবে এবং এটা সে যত বিশ্বসত্মতার সঙ্গে করতে পারবে ততই তার কল্পনাশক্তি বাড়বে এবং একই সঙ্গে সে বাসত্মব ও কল্পনাকে দাঁড় করিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারবে। একটা কথা ভাবা জরুরি, ফেঞ্চি আর ইমাজিনেশন এক নয়। ফেঞ্চি হচ্ছে এক ধরনের ভেসে যাওয়া কল্পনা। ওড়াউড়ি ব্যাপার। বাসত্মব জগতের সঙ্গে সেটা সবসময় মেলে না। ব্যাপারটা কিন্তু সুন্দর। যেমন বোম্বে ফিল্ম। খুব সুন্দর। কিন্তু বাসত্মবতা নাই। পোশাক সুন্দর, বাড়ি সুন্দর। এই হিমালয়ের নিচে নাচল আবার দৌড়ে চলে গেল সমতলে নদীর ধারে যেটা একেবারেই বাসত্মব নয়। সুন্দর পোশাক, সুন্দর বাড়ি দেখতে ভালো লাগে। সুন্দর দৃশ্য দেখালে মন আনন্দে ভরে যায়। তাই এর সঙ্গে পরিচালক পাত্র-পাত্রীকে দাঁড় করিয়ে দেয় আরও সুন্দর করার জন্য। কখনোই ভাবে না বাসত্মবতার সঙ্গে এর কোনো মিল আছে কিনা। কিন্তু ইমাজিনেশন হচ্ছে দুঃখের, সুখের হলাহল পান করে বাসত্মব মন্থনের ভেতর দিয়ে যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে উঠে আসা মানুষের জীবনচিত্র।

আমি মনে করি, তারকা শব্দটা ফিল্মের লোকজনের জন্য প্রযোজ্য বেশি। একসময় টেলিভিশনের লোকরাও তেমনভাবে তারকার পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না। টেলিভিশন যখন এলো তখন এটা ছিল সংস্কৃতির একটা শাখা। একটা সিরিয়াস ব্যাপার ছিল এর মধ্যে। সেখানে শিল্প, সাহিত্য, কল্পনা-জীবনের বড় কিছুকে আবিষ্কারের স্বপ্ন-আনন্দে বিভোর ছিল। টেলিভিশন ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে, মানুষকে মুক্তি দিবে… কত স্বপ্নই না ছিল। কিন্তু পরে তো আর এই অবস্থা থাকেনি। পরে এটা ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে যায়। এখন টেলিভিশনের উদ্দেশ্য আর সংস্কৃতিকে তুলে ধরা নয়, উদ্দেশ্য মূলত ব্যবসা। বিজ্ঞাপনের সাথে মাঝে মাঝে অনুষ্ঠান দেখা যায়। আর তাই সেখানে নায়ক নায়িকাকে বাসত্মব থেকে দূরে নিয়ে রমণীয় জগতের মধ্যে তাদেরকে দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে। সেজন্য টিভিতেও আজকাল স্টার শব্দটা বেশ জনপ্রিয়। আমরা যখন টিভিতে অনুষ্ঠান শুরু করি তখন সত্যিকার অর্থে টেলিভিশনে ভালো অনুষ্ঠান হয়েছে। তখন কিন্তু ‘স্টার’ বলা হতো না। বলা হতো পারসোনালিটি…। কারণ অ্যাজ এ পারসন- একটা মানুষ হিসেবে তাকে এসে দাঁড়াতে হতো। ভালো-মন্দ, প্রিয়-অপ্রিয়- সবকিছুই তার ওপর নির্ভর করত।

আনন্দ আলো: তার মানে টিভি ও চলচ্চিত্রের লোকজনই তারকা?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: অনেকটা তাই। কখনই অন্যান্য সেক্টরের মানুষকে স্টার বলা হয়নি। প্রতিভা বলা হয়েছে।

আনন্দ আলো: আমরা এই ধারণাকে পাল্টে দিতে চাই। একজন সফল কৃষকও তো তারকা মর্যাদা পেতে পারেন?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: হ্যাঁ, পেতে পারেন। একটা শব্দটাকে, তার অর্থকে আমরা সম্প্রসারিত করছি। জল আর জলবসনত্ম… আসেত্ম আসেত্ম শব্দটির সীমা বাড়ছে- জলীয়, জলজ, জলযান…। একটা জল থেকে আমরা কতকিছুই না বের করে নিতে পারি। তেমনি হচ্ছে তারকাও। তারকা শব্দটার মধ্যে কেন যেন সসত্মা সসত্মা ভাব আছে। যেমন একজন কৃষককে যখন তারকা বলা হয় তখন আমার কেন যেন মনে হয় বাড়িয়ে বলা হচ্ছে। কৃষক সাধারণত তারকা নয়। তাকে সেই মর্যাদা দিতে গিয়ে, গুরুত্ব দিতে গিয়ে তাকে যেন ছোট না করে ফেলি।

আনন্দ আলো: সবার মধ্যে তারকা হবার প্রবণতা কি আপনি লক্ষ্য করেন?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: তারকা হবার নেশা যার মধ্যে আছে সে তারকা হয় না। এটা আমার ধারণা। ক্লোজআপ ওয়ান প্রথম পর্বের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমাকে একবার কথা বলতে হয়েছিল। তখন আমি তাদেরকে বলেছিলাম তারকা হবার চেষ্টা করবে না। তারকা হলেই কিছুদিনের মধ্যে হারিয়ে যাবে। তোমরা গায়ক হবার চেষ্টা করো। সত্যিকারের সঙ্গীতশিল্পী হও তাহলে চিরদিন তারকা মর্যাদা পাবে। আলাদাভাবে যে তারকা হবার চেষ্টা করে তার পতন অনিবার্য।

আনন্দ আলো: তারকা খ্যাতির একটা বিড়ম্বনা আছে বোধহয়…

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: অবশ্যই তারকা খ্যাতির বিড়ম্বনা আছে। এবং এটা খুবই সসত্মা ধরনের। সসত্মারই বেশি বিড়ম্বনা থাকে। কারণ সসত্মা হলেই তার গ্রাহক বেশি থাকে। সসত্মা হলেই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়। যে সাধারণ মানুষের কাছে সহজে পৌঁছাতে পারে সে কখনোই অসাধারণ নয়।

আনন্দ আলো: জনপ্রিয়তা বলে একটা ব্যাপার আছে…

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: জনপ্রিয়তা খুবই নিম্নশ্রেণীর জিনিস..

আনন্দ আলো: আপনার এই মোহ ছিল না?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: না, আমার কোনোদিন জনপ্রিয়তার মোহ ছিল না। কিন্তু মানুষ একটু জানুক… একটু দেখুক…

আনন্দ আলো: এটাকে কি মোহ বলা যায় না?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: তা হবে কেন? মানুষের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই- এই জনপ্রিয়তা তো সবাই আশা করে। মরিতে চাহি না আমি এই সুন্দর ভুবনে মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই- কথাটার মধ্যে একটা মৃত্যু আক্রানত্ম মানুষের আকুতি, কান্নার শব্দ শোনা যায়। এই পৃথিবীতে সবই থাকবে অথচ আমি থাকব না। কিন্তু একটা মাত্র উপায় আছে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার যদি জীবনত্ম হৃদয় মাঝে স্থান করে নেওয়া যায়। সুতরাং মানুষের হৃদয়ের মাঝে আমি বাঁচতে চাই। এটা জনপ্রিয়তা নয়, অমরত্ম লাভের আকাঙক্ষা। জনপ্রিয়তার আকুতি আর অমরত্মের আকুতি এক নয়। জনপ্রিয়তা ক্ষণস্থায়ী। অমরত্ম দীর্ঘস্থায়ী। জনপ্রিয়তা একটা বাজারের বিষয়। অধিকাংশ সময় এটা ব্যবসার বিষয়ও।